দৌড় দে মেলু!
দৌড় দে মেলু!
মেলু শুনতে পায় তাঁর বন্ধুর গলা। কিন্তু মনোযোগ দেয় না। তাঁর মনোযোগ শুধু সামনে।
খাঁ খাঁ রোদ্দুর। আকাশে তাকালে দোষ। মাটিতে শুধু ধুলো। প্রতি পায়ের দাপনে ধুলো উড়ছে এক অনাবিল নাচনে। সামনে পানি, মেলু ধরলেই বরফ।
বরফ পানি! সহজ খেলা। জিতার নিয়ম সহজ। জোড়ে দিতে হবে দৌড়।
সব্বাইকে বরফ বানিয়ে রেখেছে মেলু। শুধু একজন বাকি। তার পিছেই ছুট। তাকে ধরলেই জিত। কিন্তু সময় তাঁর সঙ্গে নেই! টিফিন টাইম শেষ। সবাই ফিরে যাচ্ছে ক্লাসরুমে। মামারও মাঠে নেমে পড়েছে। খেলতে নয়, থামাতে। যাকে দেখছে তাকেই ধরছে।
তাও মেলু দৌড়োচ্ছে। সামনের বন্ধুকে ধরতেই হবে। আজকে হবেই। সেই বন্ধুও থামছে না। সেও দৌড়োবে, শেষ পর্যন্ত দৌড়োবে। অন্য কেও হলে বলতো, আজ খেলা শেষ মেলু, ঘন্টা দিয়েছে ধরতে পারোনি, জিতেছি আমি।
কিন্তু সে বলেনি। মেলুও জানে সে বলবে না। সে জানে এই দৌড় এখন জিতা হারার দৌড় না। এই দৌড় আবেগের। জিত বা হার, নিশ্চিত হলেও তারা দৌড়াতো। তাই তারা দৌড়াচ্ছে। মামার ধমক কারো কানে যাচ্ছে না। ধমক আরো উদ্ধত করছে!
এই ধরলো মেলু। হাত বাড়ালো সে। সাদা শার্ট এর ছোয়া লাগলো। এই তো। আর একটু!
ধপ! দুরুম! দুরুপ!
পরে গেলো মেলু! ধুলোতে খেলো ডিগবাজি! সাদা শার্ট ধুলোর ছলে হয়ে গেলো হলদে। মামা খিঁচকে বলল “হয়েছে”! সামনের পানি এলো। হাত বাড়ালো মেলুর দিকে। তাঁর মুখে বিজয়ের হাসি। মেলুও হাসছে। এই খেলায় হারলেও হাসা যায়। পড়ে গেলেও হাসতে হাসতে উঠা যায়। সমস্যা নাই! ছুটির পর আবার দৌড়োবে। মসজিদে কে আগে পৌছাই দেখতে হবে!
দৌড় দে মেলু!
চিৎকার দিলো বন্ধু। মেলু কে বলা লাগবে না। সে দেখেই বুঝেছে। ধরে ফেলেছে। কিন্তু তাকে বাঁচতে হবে। মেলু দিলো দৌড়। সে কি দৌড়! ক্লাস বাঙ্ক করেছে তারা। এখন তাঁদের পিছে যম!
পি.ই টিচার মূশ্তাফির যম! মেলু কে দেখে ফেলে তিনিও দিলেন দৌড়।
মেলু বড় বড় পা ফেলিয়ে দৌড় দেয়। কঙ্ক্রিট এর মেঝেতে ধাপ ধাপ শব্দে সে দৌড়ায়।
সে শব্দে আর যমের ধমক শোনা যায় না। আসে পাশে তাকায় সে। সবাই ক্লাসে বেশ্ত। চেয়ারে বসে, পা নাড়িয়ে, মাথা ঝুকে সবাই লিখছে। তখন মেলু হাত পা বাড়িয়ে, বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলিয়ে দৌড়াচ্ছে!
পিছে তাকায় মেলু। যম তাঁর অনেক কাছে! পি.ই টিচারকে সে ছোটো করে দেখেছে! বড় ভুল! মেলু আরো জোরে পা ফেলে। সিড়ি ধরতে শরীর মোচর দিয়ে ঘুরায়, ছয় সিড়ি পার করে লাফ দেয়। তিন সিঁড়ি পার করে উঠে। উঠতে উঠতে যম আর পারে না। বয়স হয়েছে।
মেলু বিজয়ের হাসি হাসে। লুকিয়ে ক্লাসে ঢুকে পরে। বিজয়ের গীত গেতে থাকে সে।
শেষ রক্ষে আর হয় না! বন্ধু জোরে নাম বলে ফেলেছিলো যে!
মেলু আর দৌড়ায় না।
এখন মেলু হাটে। মেলু এখন নাইন টু ফাইভ। কোরপোরেট অফিসার। তাঁর পায়ের নিচে সাদা ধপধপে টাইলস। বেশি শব্দ করে না। এখনো দৌড়ানো লাগে। কিন্তু এই দৌড় আর ঐ দৌড় এক না। এই দৌড় তাগিদের। আবেগের নয়।
তাই হাটছে মেলু। রিকশা থেকে নেমে পড়তে হয়েছে। বিশাল জ্যাম। রাতের আগে ছুটবে না। কিন্তু মেলু কে বাসায় পৌছাতে হবে। খেয়ে আবার বেরোতে হবে। বাচ্চাটাকে কোচিং এ নিতে হবে।
মেলু অলি গলি দিয়ে এগোয়। তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি। আগে গেলেই বাঁচা যায়।
মেলুর হঠাৎ খেয়াল হলো। এই দিক দিয়ে গেলে স্কুলের পাস দিয়ে যায় আর খুব একটা বেশি হাটাও হয় না।
ঐ দিকেই এগুলো মেলু। বেশি আর ভাবলো না। রাস্তাটা খুব ভালো ভাবেই চেনা। একটু বদলিয়েছে। রাস্তা ভালো হয়েছে। দেয়ালের রং বদলিয়েছে। কিন্তু মেলুর মনে একি আছে। বুকের এক গভীর কোনে একটা ছোটো হাহাকার দিয়ে উঠে, সে তা আগলে রাখে।
সে বামে দেখে, সোজা ফাকা রাস্তা। সামনে স্কুলের পিছের গেট। স্কুল ছুটি হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। তাই কেও নাই। সামনে এক কোনে শুধু এক পুলিশ ঝিমুচ্ছে।
স্মৃতি উকিঝুকি দেয়। সে প্রয়োজন ভুলে যায়। একটু একটু করে সে পা বারায়।
সে কিছু ভাবছে না। মাথা ফাকা। ভাবার জায়গা পাচ্ছে না সে।
পায়ের গতি আস্তে আস্তে বাড়ে। কতদিন হায় কতদিন! পা যেনো অনেকদিন পর চালু হল। রক্ত গরম! স্মৃতির প্রেরণায় পায়ের গতি বাড়তে থাকে। সে কি গতি! এইতো দৌড়!
দৌড়ায় সে। মেলু দৌড়ায়! সে বুঝে আগের মতো দ্রুততা নেই। কিন্তু তার প্রয়োজন নেই। এই দৌড় দ্রুততার পরীক্ষা নয়, এই দৌড় জিতার নয়। এই দৌড় আবেগের।
আসে পাসে সব সাই করে চলে যায়। মেলু আর থামে না। আজকে সে মেলুকে যে কেও থামাতে পারবে না!
পুলিশ জেগে উঠেছে হয়তোবা। জোরে ডাক দেয়। এই এই! মেলু শুনতে পায় খেয়াল করে না। দৌড়ে শব্দ যেনো পালটে যায়। সে যেনো শুনতে পায়।
দৌড়ে দে মেলু!