আশা
আমি খুব মনোযোগ করে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। দোতলায় আমাদের বাসা। তাই রাস্তাটা খুব কাছাকাছি থাকে সবসময়। আমার জন্য একটু উচা হয় জানালাটা। একদমি দেখতে পারি না তা নয় কিন্তু মন মতো না। তাই আমি সবসময় একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এসে হাটু গেড়ে বসে থাকতাম। এখনি তা করে আছি। একদম সামনে বেশ পুরাতন একটা বিল্ডিং। তিন তলার। কখনো কপালে রং জোটেনি। ছাই হয়ে সবসময় বিষণ্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে আজ খালি সে নয়। সবাই বিষণ্ণ ,সবাই ছাই।
ছাই রঙের মেঘ আকাশ ঢেকে দিয়েছে। এখন যে ভর দুপুর বলার উপায় নাই। মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই। ইংরেজি বইতে পড়েছিলাম একে বলে, “রেইনিং কেটস অ্যান্ড ডগস”। কুকুর বিড়ালের সাথে বৃষ্টির কি সম্পর্ক বুঝতে পারলাম না। রাতুল স্যার জিজ্ঞেসও করেছিলাম কিন্তু আমার কথা কেনো জানি শুনতে পাননি।
সব বিষণ্ণ থাকলেও আমার মন চঞ্চল । সামনের বিল্ডিং এর পাশে একটু করে মেইন রোড দেখা যায়। ঐ দিকেই মনোযোগ। আমার মাস্টার মশাই ঐ দিক দিয়েই আসেন। আজ আসার কথা ছিলো। এই বৃষ্টির মধ্যে আসতে পারবেন না মনে হচ্ছে। এই বৃষ্টি তে তো বের হওয়াই দায়। যে বেড়িয়েছে তারো বাসায় ফিরে যাওয়া উচিৎ।
আমার মাস্টার মশাই অংকের বিজ্ঞ। আমাকে শুধু অংক পড়ান। তৃতীয় শ্রেণির বার্ষিক পরিক্ষায় অঙ্কে বেশ খারাপ করেছিলাম। এরপর বাসায় তো লঙ্কা কাণ্ড। বাবা ফোন দিলেন তাঁর নিজের স্কুল শিক্ষক কে। মাস্টার মশাই এক দৌড় দিয়ে হাজির। বলেছিলেন তোমাকে মানুষ করেছি তোমার ছেলেকেও পারবো। এরপর থেকে উনার সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে আমার ছয় বার দেখা। রবিবার তিনি আসেন না। তিনি প্রতি শনিবার শিবের জন্য উপোস রাখেন।
আজ বুধবার। আজকে উনার এতক্ষণে আসার কথা। কিন্তু এখনো আসেননি। বৃষ্টি থামার অপেক্ষাতে আছেন বোধহয়। কিন্তু এই বৃষ্টি থামবে না মনেহয়। আর এতক্ষণে না আসলে আর আসবেনও না। তাও বসে আছি। গত এক বছরে তিনি রোববার ছাড়া একবারো বাড়ি আসতে ভুল করেননি। কেনো জানি ভয় হয় ছাতা ধরে, পায়জামা উঠিয়ে তিনি এসে পড়বেন। যদি তাকিয়ে থাকি, তাহলে বোধহয় তা হবে না।
যদিও ছাতা দিয়ে এই বৃষ্টি থামানো যাবে বলে মনে হয় না। তেমন বাতাস নেই, তবু যেভাবে পড়ছে তো পড়ছেই, উপায় নেই।
দুপুরে আকাশ যে এরকম হতে পারে তা জানা ছিলো না। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ পরেই রাত্রি হবে। কিন্তু মোটে সোয়া দুই। কি ভুতুরে ব্যাপার সেপার!
আমি শুনেছিলাম রাশিয়ায় শীতকালে নাকি ৪৬ দিন আকাশ অন্ধকার থাকে। রাত দিনের পার্থক্য বুঝা যায় না। আগে বুঝতে পারিনি কিভাবে তা সম্ভব। বোধহয় এভাবেই।
ভালো হতো তাহলে, ৪৬ দিন মাস্টার মশাই আসতে পারতেন না।
আজ অবশ্য শীতকাল না। বর্ষায়ও না। এখন চলে এপ্রিল। এপ্রিলে এত বৃষ্টি পড়ার তো কথা না। গ্রীষ্মের মোটে শুরু। তবে খুব বেশি অবাক হওয়াও আর চলেনা। রাশিয়ায় ৪৬ দিন অন্ধকার থাকে, আর মাঝে মাঝে এপ্রিলও বৃষ্টি হয়। কারণ খোজা লাগেনা, তাজ্জব হওয়া চলে, মেনে নিতে হয়।
একদম নিচের দিকে তাকালে আমাদের বাসার সামনের রোড দেখা যায়। পানি জমে গেছে। বেশি না, গোড়ালি পর্যন্ত। আগে এর অর্ধেক বৃষ্টি হলেই হাঁটু পানি হয়ে যেতো। এখন আর হয় না। বাবা বলে কলকাতা বদলে গেছে । কিন্তু এতো কষ্ট নিয়ে বলল কেনো বুঝি নাই। বদলানো কি ভালো না? আমার এক বন্ধু আছে। ঠিক বন্ধু না অবশী আমার থেকে বড় হয়। আমার স্কুলেরই। প্রতিদিন টিফিনের সময় তাঁর সাথে বসি স্কুলের পিছনের দিকে। বছরের শুরুর দিকে যখন ক্রিয়া প্রতিযোগিতা হয় তখন তাঁর সাথে পরিচয় হয়। আমাকে একটা সিগারেটর বাক্স দিয়ে বলেছিল ব্যাগের ভিতর লুকিয়ে রাখতে। সেইদিন সারা দিন বাক্সটা আমার ব্যাগে ছিলো। ভুতের থেকেও ভয়ের কিছু আছে সেইদিন জেনেছিলাম। বলেছিল এর বদলে আমাকে জীবনমুখী শিক্ষা দিবে যা নাকি স্কুলে দেয় না। প্রতিদিন তাঁর কাছে যাই কিন্তু ঠিক জীবনমুখী শিক্ষা এখন পর্যন্ত দিলো না। কিন্তু বেশ মজার মজার কাহিনি বলে সে। একবার নাকি বাংলাদেশে গিয়ে ডোরাকাটা বাঘের সামনে সে পড়েছিলো। জানে কোনোমতে ফিরেছিলো ওইবার। তাঁর মা নাকি বাঙালি। তাই আগে বাংলাদেশে অনেক যাওয়া হতো। এখন নাকি আর হয় না। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কেনো কলকাতা বদলে গেছে। বা এতো বিতৃষ্ণা নিয়ে বলার কি আছে। বলল তোমার কোনো কাছের জিনিস বদলালে তোমার কষ্ট লাগবে না? আমি ভাবলাম কিন্তু কাছের জিনিস আমার কি হতে পারে বদলে পারলাম না। সে বলল তোমার এই ব্যাগ? আমার স্পাইডারমেন ব্যাগ টা বেশ প্রিয় ছিলো কিন্তু নতুন যদি স্পাইডারমেনের ব্যাগ আনে তাহলে আমার তো কোনো সমস্যা নাই। বলল কোনও খেলনা? বললাম নতুন খেলনা কিনলে আগের টা দিয়ে খেলতে যাবো কেনো?
সে বলল আমার নাকি বয়স হয়নি কোনও কিছু কাছের হওয়ার। একটু বিরক্ত হলাম। বললাম না বলতে পারলেই নয়। সে বলল আচ্ছা যদি তোমার মা বদলে যায়? আমি বললাম মা আবার বদলাবে কিভাবে? মা তো মাই। পরে কিছু আর বলেনি।
বাসায় কেও নেই এখন। বাবা অফিসে। মা দিদার বাড়ি। মাস্টার মশাই আসবে বলে আমাকে নিয়ে যায় নাই। এখন মাস্টার মশাই ও আসবে না। ভালো হয়েছে। আসলে রাগ করে বসে থাকবো। শুধু শুধু আমকে রেখে গেলা কেনো? যদিও দিদার বাসায় যাওয়ার কোনও ইচ্ছা নেই। অঙ্ক না করতে পারলেই হলো। ভেবেছিলাম আমাকে নিয়ে যাবে। তাই গতকাল বাসার পড়াটাও করেনি। এখনো সব করিনি। বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গিয়েছিলো। খুব ভালো দিন বৃষ্টিটা পড়লো। এই বৃষ্টিতে মাস্টার মশাইও আসতে পারবেন না।
চেয়ার থেকে নামলাম। এতক্ষণ হাটু গেড়ে বসে থেকে ব্যথা হয়ে গিয়েছিলো। বাথরুমে গেলাম, দেখি কারেন্ট নাই। আমার মাথায় হাত। টিভি দেখার লোভেই তো পড়াশুনার বলি দিলাম। কষ্ট পেলাম। সব ঠিকঠাক হলেও কিছু ঠিক থাকে না।
এই অলস সময়ে বাসার খুটিনাটি খেয়াল করা যায়। আলমারির উপর ধুলা জমে গেছে। দেয়ালের এক কোনে রং একটু খসে গেছে, রান্নাঘরের উপর বেশ বড়সড় মাকড়সার জাল। কি করা যায় তা ভাবতে ভাবতে বাসা পাঁচ ছয় বার চক্কর দেয়া হয়ে যায়। বাসাটা আগে বেশ বড় লাগতো, কিন্তু মা এর পছন্দের সৈখিন সব ফার্নিচারের কারণে এখন ছোটো হয়ে গেছে। হঠাৎ টের পেলাম নিজের ঘরের ভিতর ঘুরাঘুরি করতেই বেশ মজা পাচ্ছিলাম। নিজের বাসাকে বেশ অদ্ভুত মনে হচ্ছিল। ভর দুপুরে পুরা ঘর ছাই। সব কিছু চেনা, কিন্তু স্মৃতির ফাটল দিয়ে কিছু কিছু অজানা। আমি বাসার সব জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। মাথার ভিতর চিত্রটা গেড়ে দিতে চাইলাম। কেনো জানি মনে হয় এরকম আরকেটা দিন হবে না। কথাটা অর্ধেক ঠিক ছিলো। বয়স হওয়ার পর বুঝলাম ঐরকম দিন আরো অনেক এসেছিলো অনুভুতি একি রকম ছিলো না।
কখনো বিকেলে ঘুমাই না। ঘুম আসে না। কিন্তু আজ পরে বড্ড ঘুম পেলো। হেলতে দুলতে শোয়ার ঘরের দিকে এগুতে থাকলাম। হঠাৎ বেশ ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করলো। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। বিশাল জোরে এক ঘন্টার শব্দ। আমার বুক ঢিপ দিয়ে উঠলো। দাঁড়িয়ে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর আবার বাজলো। তাড়াতাড়ি দরজার দিকে এগুলাম। কে হতে পারে? এত তাড়াতাড়ি মা বাবা কারোরই আসার কথা না। বুঝলাম ইন্দ্রকে সাহস করে যম নিজে এসে পড়েছে। সাত পাঁচ আর না ভেবে দরজা খুলতে নিলাম। আমাকে থামাতেই বোধহয় হঠাৎ ডায়াল ঘড়ি টা বেজে উঠলো। এখন আর থেমে লাভ নেই। দরজা খুলে ফেললাম।
“বাবা এই মাসের বিদ্যুৎ এর বিলটা” লোকটা রসিদ লিখতে লিখতে বলল।
“বাবা মা ঘরে নেই আঙ্কেল, কালকে আইসেন।” বলে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। এই যাত্রায় মনে হয়ে বেঁচে ফিরলাম। শুয়ার ঘরে এগুতে থাকলাম অবশ্য ঘুম সব চলে গেছে। ডায়াল ঘড়ি টা আবার বেজে উঠলো। আর দরকার নাই রে। ধন্যবাদ চেষ্টা করার জন্য। ফোনটা ধরলাম।
“হ্যালো লিটন? হ্যাঁ আজকে তোমাকে সন্ধ্যার দিকে পড়াবো। পড়া করে রেখো।”
“জ্বি”
ফোনটা রাখলাম। আবার চেয়ারের সামনে হাটুগেড়ে বসলাম। ভালো হয়েছে রাশিয়ার মতো ৪৬ দিন অন্ধকার থাকে না। তাহলে ৪৬ দিন আশায় থাকতাম।