নিতান্তই
কেন্টিন এর তিন টাকার পাঁচটা সিঙ্গারা নিয়ে বসেছিলাম। একটা বোতলে সস ভরা ছিল। সস এর রং গাড় লাল আর হালকা কমলা এর একটা মিস্রন, আর বিভিন্ন জায়গায় একটু সস পচে কালো হয়ে লেগে ছিলো, সস ঢালতে গিয়ে কিভাবে এমন জায়গায় গিয়ে লাগে ঠিক ধরতে পারলাম না। সস এর বোতল টা ধরলাম, আঠা আঠা ছিলো। হালকা একটু ঢাললাম , তখনি মনে হলো কে জানো ডাকল, যেনো কোন শয়তানি করতে গিয়ে ধরা দিলো।
“মারুফ না?” একটা মেয়ে বলল, মেয়েটা কে চিনি, আমার ডিপার্টমেন্ট এর এই, তন্বী নাম মনে হয়।
হ্যা বললাম শুধু আমি।
“কয়দিন পর দেখলাম।” বলে সে আমার সামনে বসলো। হাতে কেন্টিন এর ঈয়া বরো খিচুড়ির প্যাকেট। একজনের জন্য অনেক বেশি। তন্বী এর সাথে মনে শুধু দুইবার কথা হয়েছে, শেষবার আমাদের একটা গ্রুপ প্রজেক্ট এ আমরা একি গ্রুপ এ ছিলাম এরপর আর যোগাযোগ রাখা হয়নি।
“ঐ গ্রুপ প্রজেক্টের এর সর্বনাশ এর পর আর কথা হয়নি।” বললাম আমি।
“ঐ গ্রুপ প্রজেক্টের এর সর্বনাশ এর পর কয়েকদিন আমার কারো সাথেই কথা হয়নি।” কিঞ্চিৎ হাসলাম।
“তোমাকে এই সময়ে এইখানে তো কখনো দেখি নি।” জিজ্ঞেস করলো সে।
“অন্য সময় বাসাতেই লাঞ্চ করি। আজকে আর যাই নাই। তাই এখানেই খেতে বসলাম”
“এইটা তোমার লাঞ্চ?” খানিকটা অবাক হয়ে বলল সে।
“খারাপ কি?”
“একটু বেশি হয়ে গেলো না?”
“সবসময় এতো অল্প খাই না কিন্তুু এখানের আর কিছু ভালো লাগে না। পাঁচটার বেশি সিঙ্গারা নিলে তাও পচে যাবে।”
“খিচুড়িটা তো ভালো।”
“এতে আবার আমার জন্য বেশি হয়ে যায়।” মনে করে “আমার জন্য” টা বললাম বলে নিজেকে মনে মনে বাহবা দিলাম।
“পরে অভ্যাস হয়ে যাবে অল্প খেতে খেতে। একদিন দেখবা অনেক খেতে চাইলেও খেতে পারবা না। তখন যে কষ্টটা লাগবে তা বলার মতো না।”
“তোমার হয়েছে?”
“হ্যাঁ স্কুল এ থাকতে। মার উপর ভয়ংকর রাগ করেছিলাম। কিছুই খেতাম না। দিলে খাবার ছুড়ে ফেলতাম। খালি বাইরে থেকে পুরি খেতাম। দুইদিন এর ডায়েট ছিলো খালি পুরি। চিন্তা করতে পারো? এখন তো আমার পুরি দেখলেই বমি আসে। আমার বাসায় যাওয়ার রাস্তায় একটা ভাজা পোড়ার দোকান। বেশ বড়, তাই যাওয়ার সময় গন্ধ আসে। এর জন্য আমি ঘুরে বড় রাস্তা ধরে যাই তাও ঐ দিক দিয়ে যাই না। তো যা হোক এরপর রাগ কমলো আসতে আসতে সাধারন ভাবে খাওয়া শুরু করলাম। কিন্তূ যাই খাইতাম বমি করতাম। এরপর স্যালাইন টেলাইন খেয়ে একটু সুস্থ হলাম। সাধারন ভাবে খেতে পারি। কিন্তু একটু খেলেই পেট ভরে যেতো যাই খেতাম। যা আগে দুই প্লেট খেতাম, এখন অর্ধেক প্লেট খেয়েই শেষ। এতো কষ্ট লাগতো যখন প্রিয় কোনো খাবার খেতাম। আমার মন আরো খেতে চাইতো, মুখ আগ বেরে থাকতো কিন্তূ পেটে যায়গা নাই। জোর করে মুখে পুরতাম, কিন্তু মুখে রাখতে পারতাম না, মনে হইতো বমি করবো তাই কিভাবে যেনো গিলতাম। খুব খারাপ লাগতো, মনে হতো আরে এইটা তো আমার পছন্দের খাবার, তাইলে খেতে পারছিনা কেনো? এ আবার কেমন শাস্তি।”
মনে মনে ভাবলাম ঐ খিচুড়িটা তো মনে হয় পুরাটাই খাবে, তাই তার গল্পের ক্রেডিবিলিটি নিয়ে একটু প্রশ্ন উঠছিলো।
“তাও কপাল ভালো এখন ঠিক হয়েছে। খেতে পারি আগের মতোই। আপনা আপনাই ঠিক হয়েছে। ওষুধ খেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু বাবা আবার ওষুধ ডাক্তারে সহজে যেতে চায় না। তাই বলিও নাই। বলবোই বা কিভাবে? এমন একটা সমস্যা না পারি ঠিকমতো কইতে না পারি সইতে।”
“আমাকে তো ভালো ভাবেই বুঝালে। তবে হ্যাঁ, ভালোই বেগতিক অবস্থা খেয়াল রাখবো নে”
সে একটু কি ভেবে অবাক হয়ে তাকালো। কিছু কি ভুল বললাম? এরপর সে হাত গুটিয়ে খাওয়া শুরু করলো। আমিও একটা সিংগারা মুখে দিলাম।
“আসলেই তো। কাউকে আমি এটা ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারি নাই কখনো। তোমাকে কিভাবে বললাম?”
“কখনো না?”
“না” হাতের কোনায় লাগা খিচুড়ির দানা আলতো করে চেটে সে বলল। আরেকটা সিঙ্গারা মুখে দিয়ে ভাবলাম একটু।
“আমাকে বলার সময় অতো সাত পাঁচ ভাবো নি। কি ভাববে না ভাববে, যাকেই বলার চেষ্টা করেছিলে সে তুমি যেভাবে বোঝাতে চাচ্ছো ঐ ভাবে বুঝবে কিনা এইটা ভাবতে ভাবতেই আর বলো নি আর বললেও ঠিক মতো বলা হয়ে উঠে নাই।”
সে শ্বাস নিয়ে খিচুড়ির দিকে তাকালো, পরে আবার আমার দিকে।
“খারাপ বলোনি। তবে ঠিক এটা না। আমি বলার আগে সবসময় ভাবি। মাথার পিছে তো সবসময় চলতেই থাকে, সিধান্তটাও ঐ খান থেকে হয়। মাথার পিছ টাই বলল তোমাকে বললে বুঝবে বা বোঝাতে পারবো মনে হয়।”
“তাও হতে পারে।”
সে ধিরে ধিরে অর্ধেক খিচুড়ি সাবার করে নিলো। এতো যেহেতু খেতে বলল, একটু খিচুড়ি দিলেও তো পারতো, মানা করতাম না। এইদিকে আমার সিঙ্গারা শেষ। গিয়ে একটা চা নিয়ে বসলাম উঠে গেলে আবার অভদ্রতা হবে কিনা।
“একা বসে ছিলে যে?” মুখের খিচুড়ি গিলে সে বলল।
“একা বসা যাবে না?”
“আর কাউকে দেখছো একা বসে খেতে?”
“তুমিও তো একাই খেতে এসেছিলে।”
“একজনের সাথে এসেছিলাম। কে যেনো কল দিলো বলে চলে গেল। নাকি তাও দেখো নাই?”
“সস আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো।”
সে সস এর দিকে তাকালো আর হাসল।
“হ্যাঁ খুবি আকর্ষণিও” সে গাড় গোলাপি রঙের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করলো। দুই ঢক গিলে আবার আমার দিকে তাকালো।
“আমাদের ডিপার্টমেন্ট এর কাউকে ভালো লাগে না?”
“ভালো লাগে না বলতে?”
“এমন কেও নাই যার সাথে আসতে পারতে?”
“যাদের সাথে আসা যায় তারা কেও ছিলো না আরকি।”
“লোকের আর অভাব আছে নাকি, খাওয়ার সময় তো কাওয়াও আসে”
“তাই বলে কাকের সাথে বসে খাবো?”
“একা বসে থেকে সস এর সৌন্দর্য উপলব্ধি করার থেকে ভালো না?”
“-” সাথে সাথে কিছু বলতে পারলাম না। ভাবলাম কিছু আর বলবো না, ঠিক কোন কাজের কথা বলে মনে হচ্ছিলো না। চা এর দিকে মনোযোগ দিলাম। কিন্তু ফিরে তাকিয়ে দেখলাম সে উত্তর এর অপেক্ষা করছিল।
“কি বলতে চাচ্ছো?”
“তোমায় দেখে টম হারডি এর কথা মনে পড়ে। মানে চেহারা না, স্ক্রিন প্রেসেন্স টা। খুব শক্তপোক্ত কিন্তুু ইমোসনালি দুর্বল এই টাইপ এর।”
“কি দেখে এমন মনে হলো?” বেশ জোর দিয়েই বললাম। রাগ করে বা খুব ইমপ্রেসড হয়ে এমন না। ভীষণ কৌতুহল হলো বলে।
“তেমন ভাবে বলি নি। শুধু মাথাই যা আসলো তাই বললাম আরকি। দেখতেছি মাথায় যাই আসে তোমাকে বলা যায়, আজব কাণ্ড।”
নিজে যে বাচাল তা স্বীকার করলেই তো হয়। অবশ্য মুখ ফুটে তা বলতে পারি নি।
“ডিপার্টমেন্ট এর কারো সাথে আসার থেকে একা আসাই ভালো। একা থাকতে ভালো লাগে?” সে আবার জিজ্ঞেস করলো।
“টম হারডি ইমপ্রেশন নিশ্চিত করতে চাচ্ছোা?”
“হু” সে খিচুড়ির যা বাকি ছিলো তা হাত দিয়ে কাচাতে কাচাতে বলল। কেন জানি মনে হলো খাঁটি মন থেকেই কথা গুলা আসছে বা বলার জন্য শুধু বলছে না, তাই আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম।
“একা থাকতে তো আর কারোই ভালো লাগে না। মানুষগুলো খারাপ না। চেনাশোনা হিসেবে ঠিক আছে, কিন্তু বন্ধু হিসেবে, কিভাবে বলবো, হতাশজনক।” নিজের কথা শুনে নিজেই হেসে দিলাম। সেও মুখটা বেঁকে হীনভাবে তাকাল আর হাসল।
“পরিচিত হিসেবে ভালো কিন্তু বন্ধু হিসেবে হতাশজনক।” হেসে বলতে লাগলাম, “নিজের অটোবায়োগ্রাফি তে এই লাইনটা লিখব।”
“হ্যাঁ। বইয়ের পিছে দেয়া থাকবে আর আমি ওইটাই দেখে কিনবো। কিভাবে একটা মানুষ এই কথা বলতে পারে এই ভেবে। হয়তোবা এমন কিছু বলবে যা কখনো ভাবিনি বা বুঝিনি। পরে পুরাটা পড়ে বলবো কি বাকওয়াস লিখেছে! কিন্তুু দেখব এটা পড়েই নাকি মানুষ ‘ইন্সপাইয়ারড’ হয়েছে। কি ননসেন্স!”
“হয়েছে বোধহয় এমন?”
“হয়েছে। দা এলকামিস্ট পড়ে যে ধোঁকা খেয়েছি তা আর বলার মতো না।”
আমি বই এর নাম শুনে ‘আহ’ একটা শব্দ করলাম যা সে সহমত হিসেবে নিলো। খুশি হয়ে সে আরো বলতে লাগলো,
“মানে কিভাবে? বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অনুদিত বই, শুনেই তো মনে হয় মাস্টারপিস পড়তে যাচ্ছি। কিন্তূ তার বদলে কি? নির্লজ্জ একটা বই। একটা যে বিনয়ীতা থাকবে যে না, এটা একটা দৃষ্টি মাত্র, ভেবে দেখো। তা না, এমন ভাবে বলছে যেন জীবনের সত্য বলে দিচ্ছে আর আমাদের খালি জানাটাই বাকি। সেই কথা আবার সমর্থন করার ও যোগ্যতা নেই। শুধু ফাঁপা বুলি বলেই যাচ্ছে তো বলেই যাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হয়েছে পড়তে। ভাবলাম শেষ এ হয়তোবা কিছু আছে, নয়লে এতো বিখ্যাত হয় কিভাবে, নিশ্চয় শেষ এ কিছু আছে যা পুরা গল্পের মোড় ঘুরায় দিবে, কিন্তূ না! যা বলতে ছিলো তাই বলতেই থাকে। এতোটা সেলফ এবসরবড বই দেখি নাই। পুরাটা সময় নিজেকে নিজেই দেখে খেচতেছিলো বইটা। কিভাবে এটা পড়ে মানুষ অনুপ্রানিত হয় আমার মাথায় ঢুকে না।
কিভাবে মানুষ এই বই পছন্দ করে?”
তার আবেগ পূর্ণ ঘৃণা শুনে হেসে দিলাম। তবে তার বিবেচনার সাথে পুরাপুরি সম্মত ছিলাম। বলতে লাগলাম,
“আমার মনে হয় যারা “When you want something, all the universe conspires in helping you to achieve it.” টাইপ এর কথা শুনে যারা অনুপ্রানিত হয় শুধু তারাই এই বইটা পছন্দ করে এবং করবে। এই টাইপ এর আরো অনেক কথাই বলে, আর কথা গুলি নিজের থেকে খারাপ না কিন্তু কথা গুলো অর্থপূর্ণ করতে যে পূর্বসুত্র বা প্রসঙ্গ থাকবে তার কিছুই নাই। মানে আমিও তোমার মতো বোকা হয়ে বসেছিলাম, কি পরলাম এটা?”
“ওই ধরনের কথা শুনে যদি কেও অনুপ্রানিত হয় আমি খুব চিন্তিত হবো সত্যি বলতে। নিতান্ত বাচ্চা কিংবা গর্দভ না হলে এসব কথা শুনে ভালো লাগার কথা না।”
“হয়তোবা ঐ কথা গুলার মাঝে নিজের জীবনের কোন একটা অংশে সদৃশ পেয়েছে বা পাওয়ার চেষ্টা করেছে, কিংবা একটু আশ্বাস পেয়েছে।”
“কি ধরনের জীবন হলে এই রকম কথায় সদৃশ পায়?” গভীর একটা চোখ নিয়ে সে বলল।
“তা বলতে পারি না। কিন্তুু আমার মনে হয় সবার এই বই তা পড়া উচিৎ কিভাবে একটা বই না লিখতে হয় তা জানার জন্য।” সে বোতল থেকে পানি খাচ্ছিল, আমার কথা শুনে পানি গিলে, বোতলের মাথা আমার দিকে ঝুকিয়ে বলল,
“একদম”
“একদম” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলাম।
তার খিচুড়ি খাওয়া শেষ। বাক্সটা একদম পরিষ্কার। একটা খিচুড়ি ও নেই। খুব পরিষ্কার করে খায় বুঝলাম। এতো বলে আমাকে যে একটু ও দিলো না তা ঠিক ভুলতে পারলাম না। আমার চা খাওয়া ও শেষ। এখন একসাথে উঠে নিজ নিজে পথে যাওয়া বাকি। কিন্তু সে বসেছিল, মনে হলো কিছু একটা বলবে তা ভেবে নিচ্ছে। উঠে গেলে নিজেই ভাববো কি বলত তাই ভদ্র ছেলের মতো বসে থাকলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না।
“আজকে তোমার আর কোন ক্লাস আছে?”
“না নাই। তোমার ?”
“আছে বিকাল ৬ঃ৩০ টায়। চিন্তা করতে পারো? সারা সেমিস্টার ঠিকমতো ক্লাস করায় নাই। এখন সেমিস্টার ফাইনাল এর আগে যতো ফাকা স্লট মেনেজ করতে পারে সবকটায় ক্লাস বসিয়ে রেখেছে। আমরা পারবো নাকি পারবো না সেটার খেতাপুরি। আবার না আসলে ক্রেডিট নাই।”
“বাজে অবস্থা দেখি।”
“হ্যাঁ। শুরুর দিকে ভালোই পড়াতো লোকটা। মাঝখানে কি যেন হলো, ইচ্ছামতো মিস দিতে থাকে। এখন পারলে প্রশ্ন টা দিয়ে দেয় খালি।”
“পরে যেনো কেও মিস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে শব্দ না করে?”
“আর কি হবে? যা হোক যা বলছিলাম আর কোনো কাজ আছে পরে?”
“৬ টার পরে আছে। এর আগ পর্যন্ত ফ্রি আছি।”
আসলে কোনো কাজই ছিল না আমার। কিন্তুু ভার্সিটির পর সারাদিন কোনো কাম কাজ নেই তা বলতে লজ্জা লাগলো। এই সময় টা কোনো না কোনো কাজ থাকার কথা কেনো জানি।
“ঘুরতে যাবা?”
একটু হতচকিত হলাম হঠাৎ এই কথা শুনে। কিন্তু চেহারা তে তা আসতে দিলাম না।
“ঘুরতে? কই?”
“প্রতিদিন সোমবার আমার একটা যায়গায় ঘুরতে যাওয়া লাগে। সেখানে।”
এটা কি এনিগমেটিক হয়ার কোনো ব্যর্থ প্রচেষ্টা ছিলো?
“প্রতি সোমবার এ ঘুরতে বের হও?”
“খালি সোমবার এই না।”
“ভালই তো”
“যাবা নাকি না?”
“চলো ৬ টার আগে আমি বের হতে পারলেই হলো।”
সে পানির বোতল থেকে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে নিলো, তারপর মুখ টা বন্ধ করে তাঁর গাড় গোলাপি রং এর ব্যাগের ভিতরে রাখলো। আমিও পায়ের কাছে রাখা ব্যাগটা নিয়ে হাটা দিলাম। রিকশা খুঁজতে অসুবিধা হলো না। মধ্যবয়সী একটা লোক, কিন্তু শরীর ভালো।
যে যায়গার নাম বলল তা চিনি না, কিন্তু ভাড়া দেখে বুঝা গেলো একটু দুরেই। উঠার পর প্রথম কয়েক মিনিট আমরা কিছুই বললাম না। সঠিক কতক্ষণ তা বলতে পারবো না কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ছিলাম। খারাপ লাগছিলো না বসে থাকতে, কঠিন রোদ কিন্তু ভালো বাতাস ছিলো। তন্বীর সাথে দেখা না হলে কি করতাম এখন? ক্যাম্পাস এর কোনো একটা কোনে বসে থাকতাম। মিনিটে মিনিটে পরিবর্তন দেখতাম আর একা একা খুশি হতাম। এরপর একসময় কঠিন ভাবে বিরক্ত হতাম, এরপর বাসায় চলে যেতাম। আজকে কোন দিক দিয়ে যেতাম? তন্বী আমার চিন্তায় হঠাৎ বাঁধ করলো।
“কি ভাবছো?”
“তেমন কিছু না।”
“ভাবছ কি একটা মেয়ে রে বাবা। দুইদিন বোধহয় হল ঠিকমতো কথা হল আর এখনি কোথায় ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে।”
“না এমন কিছু না” হেসে বললাম।
“তাহলে?”
“এখনো মন ঐ সসের বোতলে পরে আছে।”
“ধুর তোমার ঐ সস আর তুমি!” দুইজনেই হাসতে থাকলাম। সে তাঁর ঘড়ির দিকে তাকালো। মেয়েদের ঘড়ি না। কেসিও এর ছোটো পর্দার যে কালো ঘড়ি গুলা থাকে ওইটা। অনেকদিন পর মনেহলো এই ঘড়ি টা দেখলাম।
“কিছু একটা বলো।” সে বলল।
“হম, কি বলবো?”
“কি বলবা? হম। এমন কিছু একটা বলো যা তুমি কাউকে বলো নাই। কোনো সিক্রেট বা এমন কিছু না ওইটা তো সবাইকেই বলা হয়। এমন কিছু যা কাউকে বলা হয়ে উঠে নাই, এই জন্য না যে তুমি বলতে চাও না, শুধু বলো নাই আরকি।”
“কারণ ঠিকমতো বুঝাতে পারবো না?”
“কারণ ঠিকমতো বুঝাতে পারবে না।” সে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো।
“মাথায় কিছু আসছে না এখন।”
“আমার একটা আছে।”
“বলে ফেলো।”
“আমি সময় পেলে খুচরা সিনেমা হলে গিয়ে আলতু ফালতু ছবি দেখে আসি। ঐ যে, যে সব পোস্টার এ নায়ক চশমা পড়ে মাঝখানে দাঁড়ায় থাকে আর নায়িকা গুলা সেক্সি সেক্সি কাপড় পড়ে পাশে ভঙ্গি দিয়ে দাড়ায় থাকে, আর মাঝখানে লাল অক্ষরে লেখা থাকে গুন্ডা! ভিলেন! পাগলামি! আর যদি আরেকটু সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে চায় তাহলে থাকে ‘ভালোবাসা দিবি কিনা বল’ বা ‘তোমার জন্য মরতে পারি’ আর যদি আরেকটু কুল করতে চায় “টরনেডো কালাম” বা “ ঢাকার কিং”
আমি হাসতে হাসতে মাথা নাড়াতে থাকি।
“টিকেট এর দাম কম। যাই চলে তাই দেখে আসি। এতো জঘন্য! ওভার একটিং একটা ট্যালেন্ট আর এই সব ছবির নায়ক নায়িকা রা তার মাস্টার! কি যে দেখায় মাঝে মাঝে!
হরর মুভি থেকেও বেশি গোরি সিন থাকে! হাসতে হাসতে চোখ বন্ধ করে ফেলি। একটা না একটা হয়রানির সিন থাকবেই! আর সে কি সিন, পুরা পর্ণ! ১০-১২ জন মিলে একটা মহিলার কাপড় খুলতে থাকে! খুলতে খুলতে মাঝে মাঝে আবার গানও দেখি বাজে। ৩-৪ মিনিটের গান ধরে দেখি কাপড়েই খুলতেসে। ১০-১২ জন মিলেও শেষ পর্যন্ত যাইতে পারে না! দেখে দেখে মনে হয় সবথেকে মোটা মহিলাদের খুজে আনে।”
“এই সব ছবি দেখার ইচ্ছা কোথা থেকে আসে?”
“সত্যি জানিনা। আমি যাই বসে চুপ চাপ দেখি। মাঝে মাঝে তাকাই চারপাশে, কখনো কোনো মেয়ে থাকে না। থাকলেও একা থাকে না। পুরা হল চেংরা পোলাপাইন দিয়ে ভরা। মাঝে মাঝে দেখা যায় পুরা পরিবার নিয়ে আসছে। নিম্ন নিম্ন বিত্ত। ঘরে চারটা ছেলেমেয়ে,মা অন্য ঘরে কাজ করে , দিনে দুইবেলা খায়, ঈদ এ একটা নতুন জামা কিনে দেয় এমন ধরনের। কেঊ টের পেলে আমার দিকে তাকায় থাকে। যেনো আমার ঐ খানে থাকার কথা না। তাকায় তো তাকাতেই থাকে, আরে ভাই টাকা দিয়ে ঢুকেছো ছবি টাও তো দেখো! আমাকে তো রাস্তায় যেকোনো সময় দেখতে পারবা!”
“আমি ছোটো বেলায় একটা হাসপাতালে এরকম একটা ছবি দেখেছিলাম। একটা সিন আমাকে এখনো স্কার করে রেখেছে।”
“কি সিন।”
“ভয়ঙ্কর বিচ্ছিরি। বলবো না।”
“আরে বলে ফেলো আমি নিশ্চিত এর থেকে খারাপ জিনিস আমি দেখেছি।”
“নাহ লজ্জা লাগে।”
সে আমার দিকে তাকায়ি মুখ টা বাঁকালো। এরপর বলল,
“যাহোক এবার তোমার পালা।”
কিছু না বলে সামনে তাকালাম। কি বলবো? কিছুক্ষণ ভাবলাম এরপর বলা শুরু করলাম।
“মাঝে মাঝে একটা গন্ধ পায় মিষ্টি এক ধরনের। গন্ধ টা খুব ভালো লাগে। যখনি পাই, আমার খুব কোমল একটা অনুভুতি আসে, নিজেকে খুব জেয় লাগে।অনুভুতিটা খুব গাড় একটা দাগ ফেলেছে মনে, আমি খুঁজার চেষ্টা করি কিন্তু প্রায় সাথে সাথে চলে যায়। বের করে আনার চেষ্টা করি কিন্তু কখনো হয়ে উঠে না। মাঝে মাঝে মনে হয় আবার না ঠিকই আছে। বের করে আনলে হয়তোবা হারায় ফেলবো।”
“আমারো এরকম কিছু একটা হয় কিন্তূ একটু ভিন্নভাবে।”
“সবারই হয়তোবা হয় এক এক জন এক এক ভাবে নেয় আরকি। আবার মাঝে মাঝে কোনো একদিন কোনো একসময় আমার মনে হয়। এই সময় টা আমি সারা জীবন মনে রাখবো। মানে তেমন কোনো কিছুই মনে রাখার মতো হয় না, কিন্তু আমার মনে কেন জানি থেকে যায়। আমার কেনো জানি মনে আছে, হয়তোবা ক্লাস 4 এ থাকতে। বাসায় একা ছিলাম, এপ্রিল মাস ছিলো, তুমুল বৃষ্টি পরছিল। ঠিক ঝড় না, কিন্তু ভালো মতোই পরছিল। পরছিল তো পরছিলই, সবকিছু ছাই রঙের, শুধু মেঘ না, পুরা আকাশ, বৃষ্টির পানি, সামনের বিল্ডিং, আমার বাসা আমি, সবকিছুই। কিছূ একটা অনুভব করেছিলাম আমি ওইদিন। অনেক ভেবেছি কিন্তু মনে হয় না সারা জীবনে ঐ অনুভুতি টা আর আসবে। কতটুকু আসলেই হয়েছিল আর কতটুকু আমার জীবনের অভিজ্ঞতা একটু একটু করে স্মৃতিটাকে ফুল বেল পাতা দিয়েছে তাও বলতে পারবো না। স্কুল থেকে বাসায় আসলাম, হয়তোবা ক্লাস 6 এ থাকতে। এসে কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম। এরপর মা খেতে দিয়ে শুতে গেলো, আমি খেয়ে নিলাম। পরের দিন পরীক্ষা ছিলো তাও কেনো জানি খুব শুতে মন চাইলো। নিজের রূমে না গিয়ে মা এর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। মা কিছুক্ষণ বকলো কেনো পড়তে না বসে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ বকার পর ঘুমিয়ে গেলো। আমি পাশে শুয়ে আছি। ঘুম আসে না। সব চুপচাপ, জানালা দিয়ে হালকা রোদ আসছিল। এটাই আর কিছু না।” আঙ্গুল ফুটাতে ফুটাতে বললাম, “তোমারটার মতো ইন্টারেস্টিং কিছু না।” বোকা একটা হাসি দিলাম।
“হু” সে পরে সাথে সাথেই বলল,
“তোমার মা বাবা ভালো আছে?”
“হ্যাঁ। সুস্থ স্বাভাবিক।”
“ভাই বোন?”
“আমি একাই।”
“একটা মাত্র ছেলে ভালো আদর করে নিশ্চয়ই। মা তো আগলে রাখার কথা।”
“দুইজনেই করে। কম বেশি বলবো না।”
“আমার মায়ের সাথে মনে হয় ঠিকমতো গত ১০ বছরে কথা হয় নাই।”
“কেনো?” সরাসরি এই জিজ্ঞেস করলাম।
“বাবাকে ছেড়ে কার সাথে যেনো ভেগে গেছে । আমি 6–7 এ থাকতে।”
“ওহ” আসতে করে বললাম। ঠিক তৈরি ছিলাম না এটা শুনার জন্য।
“ভেগে গেছে বলা ঠিক হবে না। জানাই শুনাই গেছে। কি যে বলে গেছে আমাদের এখনো কানে ঠন ঠন করে বাজে। এই মহিলা রে কি দেখে বিয়ে করেছিলো কে জানে। দেখতেও তো সুন্দর না যা মনে পড়ে। যার সাথে ভেগেছে আমার তো তাঁর জন্য খারাপ লাগে”
“শেষ কবে কথা হয়েছে?”
“বছরের শুরুর দিকে একবার হয়েছিলো।”
“কি নিয়ে কথা বললা?”
“বাবাকে নিয়ে।”
“উনার কি অবস্থা?”
“বাবার? বাবার কাহিনি বললে তো উল্টায় পরবা। বাবার টা বলার জন্য আমাকে টাকা দেয়া লাগবে।”
“যদি ভালো লাগে তাহলে পরের দুইদিন খিচুড়ি আমি খাওয়াবো নে।”
“আচ্ছা। বাবা তো মা যাওয়ার পর একদম পাগল হয়ে গেছে। কি করলো না করলো কিছুই বুঝতেছিলাম না। হঠাৎ একদিন সে বলল, সে উরুগুয়ে চলে যাবে। যাবে তো যাবে টিকিট ভিসা সব করে রেখে আমাদের বলল। কিছু বুঝে উঠতে না উঠতেই চলে গেছে।”
“তোমার বাবা উরুগুয়ে তে!?”
“হ্যাঁ! দুই মেয়েকে আর দোকানটা রেখে চলে গেলো। আমরা দুই বোন। সে বড়। বিয়ে হয়ে গেছে। আমাদেরকে বাবা ঐ খান থেকে টাকা পাঠায়। ফোন করে না, বলে বেশি টাকা যায়। চিঠি লিখে পাঠায় আর আমাদেরকে লিখে পাঠাতে হয়। শেষ কবে চিঠি লিখেছো বা পাঠিয়েছো? আমাদেরকে এখনো পাঠাতে হয়। চিন্তা করতে পারো। ওইখানে কোন খেতে কাজ করে। আমাদেরকে তাঁর গরু, ঘোড়া, ছাগলের ছবি পাঠায়। ১০-১২ টা গরু সবার নাম দিয়ে রেখেছে। গিয়ে কারো সাথে থাকে না একা থাকে বুঝি না। চিঠির এর কনো কুল কিনারা পাই না মাঝে মধ্যে। উরুগুয়ে সম্পর্কে কিছূ জানো? ফালতু একটা দেশ। গোবর এ ভরা। বড় বড় লম্বা খালি মাঠ আর তার উপর গোবর। নিজের দুই মেয়ের সাথে না থেকে ওই গোবর এ গিয়ে থাকে। মানে একদম মাথা গেছে। আমাদেরকে বলে উরুগুয়ে চলে আসতে। হ্যাঁ কাম কাজ নাই তো পাগলের সাথে গোবরের দেশে থাকবো।”
“আমি হাসবো না কাদবো ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“হাসলে কষ্ট পাবো। হাসির কথা হলেও ভাবো একটু!”
আসলেই ভাববার বিষয়। দুই মেয়েকে এতো ছোটবেলা থেকে বড় হতে হয়েছে। নিশ্চয় সহজ ছিলো না। কোথায় জানি পড়েছিলাম অনেক হাস্যরসের মধ্যে গভীর বেদনা লুকিয়ে থাকে। এর থেকে ভালো উদাহরন দেখি নাই। সে বলল আমরা প্রায় এসে গিয়েছি এরপর চুপ করে বসে থাকলো। এই প্রথম আমি ঠিক মতো তন্বীর দিকে খেয়াল করলাম। কিভাবে যেনো কথা বলে মেয়েটা। নতুন করা রাস্তার মতো। একদম পরিষ্কার সোজা সাপ্টা। কোনো উচু নিচু নাই। একি একটা বেগ এ চলতে থাকে, একটুও এদিক সেদিক হয় না। খুব সুন্দর। তাঁর মুখটা একটু চোখা, চেহারার সব কিছুই একটু চোখা চোখ, ঠোঁট সব। তাঁর গাড় শ্যামলা ত্বকের সাথে খুব মানায়। একটা আবহ আছে যেটার জন্য ঠিক শব্দ খুজে পাচ্ছি না। গায়ে খুবি সাধারন একটা সালোয়ার কামিজ। হলুদ আর সবুজ রঙ্গের অস্বাভাবিক একটা মিশ্রণ। তাঁর ত্বকের সাথে ঠিক মানায় না। কেমন জানি বেখাপ্পা লাগে। আবহ টা নষ্ট করে দেয়।
সে রিক্সা থামাতে বলল একটা হাসপাতালের সামনে। আসে পাশে কিছু দেখলাম না। কিছুক্ষণ আগে একটা মল ছিলো আর ওটার একটু আগে একটা পার্কের মতো ছিলো
বাচ্চারা খেলছিলো।
দুইজনে নামলাম সে ভাড়া দিলো এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এসে গেছি।”
“কই?”
“এখানেই আসি ঘুরতে।”
কিছুক্ষণ লাগলো বুঝতে কিন্তু সে হাসপাতালের কথায় বলতেছিলো। আমার চেহারায় মনে হয় দেখা গেলো কারন সে বলল,
“সরি সরি সরি। এভাবে মজা করার জন্য।” সে হাত জোর করে মাথা নিচু করে ফেলল,
“রাক করো না প্লিজ। কি যেনো ভেবে বলেছিলাম, মাফ করে দিও।”
সে মাথা নিচু করে দাড়িয়েই ছিলো, কেন জানি হাসি পেলো, তাকে দেখতে কার্টুন কার্টুন লাগছিলো।
“রাক করি নাই সমস্যা নাই।”
“রাক করো নি?” সে হালকা মুখ তুললো।
“না। কথা বলতে বলতে হারিয়ে ছিলাম। তেমন কিছু ভেবে রাখিনি তাই হতাশ হতে পারছি না।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। চলো ভিতরে চলো।”
“আসবা? আসা লাগবে না কিন্তু শুধু শুধু।”
“এসে তো গেলামই না এসে আবার কি করব। কি ঘোরাঘুরি করো দেখি।”
সে ঠিক মতো তাকালো আমার দিকে। এরপর আসতে করে আচ্ছা বলে হাসপাতালের দিকে হাটা দিলো।
“সত্যি রাক করোনি তো?”
“না।”
খুবি পুরাতন বিল্ডিং । একসময় হয়তোবা ফার্স্ট ক্লাস ছিলো কিন্তু এখন ধসে যাচ্ছে। চুন মারা দেয়াল, ফ্লোরে দামি টাইলস কিন্তু এখন ভেঙ্গে যাচ্ছে। গোমট একটা গন্ধ। হাসপাতালে সবসবয় একটা গন্ধ থাকে, ভালো লাগে না আমার, কিন্তু এখানে সেটা আরো প্রকট। নার্স রা এদিক ও দিক যাচ্ছিলো। রিসেপসন এ একটা মোটা লোক বম মেরে বসেছিলো। কয়েকজন মহিলা আর বৃদ্ধ পুরুষ ভাঙ্গাচোরা চেয়ার এ বসে বসে হাই তুলছিলো। সে কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা সিড়ির দিকে হাটা দিলো। বেয়ে বেয়ে তিন তলায় আমরা ঊঠলাম। এরপর সোজা একটা রুম এ ঢুকলাম। ছোট রুম ৪ টা বেড ছিল। ৪ টা তেই লোক ছিলো। এমন ভাবে মাথা ঢাকা ছিলো যে চিহ্নিত করতে পারলাম না কিন্তু বলতে পারলাম যে বয়স্ক পুরুষ এই ছিলো। শেষ মাথার দুইজনকে দেখা যাচ্ছিল। বাম পাশের বেডের এর রোগীর পাশে একজন মধ্য বয়সী মহিলা বসে ছিলো।
তন্বী তাকে দেখে সালাম দিলো, আর মহিলাও জিজ্ঞেস করলো সে কেমন আছে।
তন্বী ডান পাশের রোগীর পাশে চেয়ার এ বসল,
“কেমন আছো বাবা?”
“তোমার বাবা না উরুগুয়ে তে!” সাথে সাথে বললাম আমি।
“মিথ্যে বলেছিলাম।”
“ওহ।”
তন্বী এরপর কাজ শুরু করে দিলো। তাঁর বাবার জামা খুলে মাথা শরীর পুরা গা কাপড় দিয়ে ঘাম মুছলো। তারপর হালকা ভিজা তোয়াল দিয়ে আবার মুছলো। তারপর নতুন এক জামা পরিয়ে দিলো। মাথার পিছে ধরে টিস্যু ব্যাবহার করে গলার কফ বের করে ফেলে দিলো। একটা বোতল ধরে পায়ের কাপড়ের নিচে ধরে রাখলো হিসু করার জন্য। পরে খাবার এনে খাওয়ানো শুরু করলো। আমি আরেকটা চেয়ার এনে বসে চুপচাপ দেখলাম। সে খুব মসৃণভাবে সব কাজ করলো। কোনো ভুল ত্রুটি ছিলো না, কোনো জায়গায় আটকে গেলো না। চুপচাপ নিজের মতো করে করতে থাকলো।
“রাক করোনি তো আসলেই?”
“আসলেই করেনি।”
“আমি হলে রাক করতাম”
“তুমি তো রাক করতেই।”
“মানে?”
“মেয়ে মানুষরা রাক করে বেশি, করতে হয়, আর কিছু না।”
লোকটা মানে তন্বীর বাবার মাথায় চুল ছিলো না। শরীর শুকিয়ে শুধু চামড়া আর হাড়। মুখ কুচকিয়ে ছিলো, ভাঙ্গাচোরা, হালকা গোফ। তার বয়স বেশি ছিলো নাকি রোগের কারনে বেশি লাগছিলো বলতে পারলাম না। শরীর এর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন টিউব লাগানো ছিলো। যদি শ্বাস নেয়ার সময় হাল্কা করে বুকটা না ফুলতো তাহলে বলতে পারতাম না বেচে আছে না মরে আছে। চোখ একদম হালকা খোলা, কিছু দেখছে নাকি আদও বুঝতে পারি না।
“বাবা, এই ছেলেটার নাম মারুফ। আমাদের ডিপার্টমেন্ট এরই।” আমার পরিচয় করায় দিলো। আমি মাথা নিচু করে সালাম দিলাম, জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছেন। কোনো উত্তর দিলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। চোখ দিয়ে কি দেখছিলেন টা ঠিক বলতে পারবো না।
“মাথায় টিউমার ধরা পরেছিল, গত বছরের মাঝামাঝি তে। বোনের বিয়ের কয়েকদিন পরেই। সব কিছুর বারোটা বাজায় দিলো বলতে গেলে। সব টাকা পয়সা দিয়ে পরে অপারেশন আর এখন এই অবস্থা। মাথা খুলে ফেলেছিলো জানো? মাথা খুলে আবার লাগায় দেয়। কি ভয়ানক। চিন্তা করতে পারো নিজের মাথা খুলে এতো মানুষ মিলে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। এর থেকে তো আমি মরতে রাজি। অবশ্যি এমন তো আর না মাথা খুলে কিছু দেখা যায়। কিছুই দেখা যায় না। শুধু মাংসের স্তুপ, সবার মাংসের স্তুপ একি।”
“হু”
তন্বী আস্তে তাঁর বাবার কানে কানে কথা বলছিল। তাঁর বাবাও ঘোঁত্ ঘোঁত্ শব্দ করে কিছু বলছিল কিছুই অবশ্যি শুনতে পারলাম না। মাঝে মাঝে পাশে বসা মহিলার সাথে কথা বলছিল। মেয়ে মানুষদের আলাপ। তাঁর স্বামী ছিল, একি অবস্থা ব্রেন টিউমার।
কতক্ষণ গেলো জানি না হঠাৎ সে বলল হালকা খুদা পেয়েছে। সে বলল আসছি বাবা এরপর আমরা নিচে নামলাম। হাসপাতাল থেকে সোজা একটা ছোট একটা ভাতের হোটেল ছিলো, সেখানে গিয়ে বসলাম।
সে একটা রুটি আর ঝাল ফ্রাই অর্ডার দিলো আমি শুধু একটি চা অর্ডার দিলাম।
“হাসপাতালে থেকে খুদা চলে গেসে?”
“না এমনিতেই খুদা লাগেনি।”
“মাঝে মাঝে দূর দুরান্তর থেকে কোন মামা চাচা দেখতে আসে। দেখে শুধু আহারে অহুরে করে। আহারে অহুরে করতে আসে খালি। এরপর এখানে খেতে আসলে বলে, ওহ তন্বী তুমি তো ভালো খেতে পারো! আমার তো তোমার বাবার এই অবস্থা দেখে খাওয়ার রুচি সব চলে গেছে। কি ঢং খালি! আমি এইখানে কাজ করে করে আঙ্গুল নরম করে ফেলছি আর রুচি চলে যায় এনাদের। যেনো খুব আরামে আছি। শুরুর দিকে সবারই এমন লাগে আমারো লেগেছিলো। আসতে আসতে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন ঘরের মতোই। সকালে বাসা ঘর মানুষ করে, কাপড় ধুয়ে ,রান্না-বান্না করে, খেয়ে দেয়ে
ভার্সিটি তে আসি, এরপর সরাসরি এইখানে, এইদিক থেকে আবার বাসায় গিয়ে আবার দোকান খুলে বসে থাকতে হয় কয়েক ঘন্টা, বিক্রি তো কিছু হয় না আবার না খুলেও থাকা যায় না। আবার সকালে উঠ, রিন্স অ্যান্ড রিপিট। বোনটা যখন ছিলো তখন তাও সময় হয়ে পাওয়া যেতো, কয়েক মাস থেকে আবার জামাই এর ঘরে গেলো গিয়ে।
তাও ভাগ করে রেখে ছিলাম, সপ্তাহে চার দিন আমি, তিন দিন সে। তাও দুই দিন পর বাচ্চার অজুহাত দিয়ে আমারে পাঠায় দেয়। আজকে তাঁর আসার কথা ছিল। আর অন্য দিকে এক বালের বাচ্চা সারে ৬ টায় ক্লাস দিয়ে রেখেছে।”
বুক থেকে কিছু একটা নামলো মনে হলো, দুজনেরই। খাবার এসে পরেছিল। আমি আসতে আসতে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম। একদমই ভালো না। সে খুব মন দিয়েই রুটি মাংস খাচ্ছিল। কয়েক ঘণ্টা আগে ঐ খিচুড়ি খেয়ে এখনি ভারি খাবার খাওয়া সবার পক্ষে সম্ভব না। তন্বী আসলেই ভালো খেতে পারে। কিন্তু তা বলে আর বিরক্ত করলাম না।
খেয়ে দেয়ে সে বসে রইল। মাথা চেয়ারে হেলান রেখে উপরে তাকায় ছিলো । বেয়ারা বিল দিয়ে গেলো। সে টাকা দিলো, কিছুক্ষণ পর বেয়ারা এসে বাকি খুচরা দিয়ে গেলো।
“চলো উঠি।” সে বলল।
“একটা কাজ করো। তুমি আরো কিছুক্ষণ বসো। আমি তোমার বাবাকে দেখছি।”
“কি?”
“কিছুক্ষণ সময় নিজের জন্য নাও। একটু হেটে আসো। মাথাটা খালি করো। ততক্ষণ আমি আঙ্কেল এর খেয়াল রাখছি।”
“কি বলছো? আমি ঠিক আছি। আর তুমি জানো কি কি করতে হবে যে বলছো?”
“মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। বোধহয় কোনো সমস্যা হবে না। কিছু না বুঝলে নার্স কে জিজ্ঞেস করে নিবো।”
সে একটু অবাক হয়ে তাকালো এরপর কিছুক্ষণ ভাবল।
“পারবা তো?”
“পারবো। তুমি চিন্তা করো না।”
এই বলে সে কিছু বলার আগে উঠে পড়লাম। হেটে হেটে হাসপাতাল এ আবার ঢুকলাম সিড়ি বেয়ে বেয়ে আমার উঠলাম, রুমে ঢুকে, তন্বীর বাবার পাশে বসলাম। পাশে বসা আন্টি আমাকে দেখলো কিন্তু কিছু বলল না।
“আঙ্কেল আমি মারুফ। তন্বী একটু পরে আসছে। ততক্ষণ আমি আছি, কোনো সমস্যা হবে না তো?”
তিনি আমার দিকে তাকালেন এরপর মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ নাকি না বুঝলাম না, কিন্তু মনে হলো না কোনো অসুবিধায় আছেন। আমার দিকে একদৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকলেন। মনে হলো না আমাকে দেখছেন। তখন থেকে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আসলে দেখছেন টা কি। মনে হচ্ছে আমাকে অন্য কেউ ভাবছেন।
“আপনাকে তো আবার খেতে হবে। এই নেন।”
তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। ঘোঁত্ ঘোঁত্ করে বললেন,
“না”
“খাবেন না?”
“না”
“না খেলে তো হবে না।”
“…….”
“আচ্ছা তাইলে আমি এই খাই।”
এই বলে শসা টা আসতে করে খাওয়া শুরু করলাম। এমন ভাবে খেলাম যেনো এর থেকে মুখরোচক জিনিস দুনিয়ায় দুইটা নেই।
“হালকা লবণ দিয়ে যা লাগছে আঙ্কেল। মিস করছেন। যানেন এতো ফ্রেস শসা পাওয়া এখন কতটা রেয়ার? আপনি তো জানেনই। বাজার তো আপনি কম করেননি।”
ঐ শসা শেষ করে যখন অন্য শসাতে হাত দিলাম তিনি তখন মুখ ঘুরালেন।
“খাবেন?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“হু” হালকা করে বললেন তিনি। এই টুকুন আওয়ায করতে কারো এত কষ্ট হতে পারে কখনো ভেবে দেখিনি।
উনাকে আসতে আসতে শসাটা খাওয়ে দিলাম। শসা বাদেও বাকি ফল গুলোও খেলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত আর না পারলেন ততক্ষণ পর্যন্ত খেলেন।
আমি তখন তন্বীকে যা যা করতে করতে দেখলাম তা সমান্তরালে করতে থাকলাম। তাকে ওষুধ খাওয়ালাম। জামা খুলে গা মুছে দিলাম, এরপর ভিজা কাপড় দিয়ে আবার মুছে দিলাম, টিস্যু ব্যাবহার করে কফ ফেলে দিলাম,নতুন কাপড় পড়ালাম, যখন হিসু করতে চাইলো তখন বোতল ধরলাম। সব করলাম। তন্বীর মতো মসৃণ ভাবে না কিন্তু কোনো সমস্যা হলো না।
পাশের মহিলা মাঝে মাঝে আলাপ করলেন। আমি কোথায় থাকি, বাবা মা কি করে, কোথায় পড়েছি পড়ছি এসব।
“তন্বী মেয়েটা কত ভালো। সময় করে ঠিকি বাবার খেয়াল রেখে চলেছে।”
“হ্যাঁ।”
“আমার ছেলে মেয়ে রে মানুষ করতে পারলাম না। খালি টাকা নেওয়ার ধান্দায় থাকে। টাকা নেয় আর খবর থাকে না। কি করছে না করছে ঠিক নাই। দুইটাই একি। রাতে দেরি করে ফিরে। তাদের বাবার যে এই অবস্থা এতো অসুস্থ এই খবর কি রাখে! একদিন দেখতেও আসে। বলি আমার শরীর পারে না প্রতিদিন, একদিন আসতে, একদিন নিজের বাবার খেয়াল রাখতে সেটা কই।”
সায় দিলাম মাথা নাড়লাম। নিজের থেকে কিছু বললাম না। তিনি তার জগত সংসার নিয়ে আরো বলতে থাকেলন, মাঝে একবার কেদে দিলেন। বললাম সব ঠিক হয়ে যাবে। শেষে সব ঠিক হয়ে যায়। তিনি কিছুক্ষণ পরে উঠে পরলেন। এলাকার বাচ্চাদের হাতে খড়ি পড়ান। সেখানে যেতে হবে।
আমি আঙ্কেল এর দিকে ফির তাকালাম। চোখ খোলা, শ্বাস নিচ্ছেন, এখন আমিও বলতে পারি উনি বেচে আছেন। একটু হলেও বেচে আছেন।
“শুনলেন না আঙ্কেল। আপনার মেয়েটা অনেক ভালো। আপনারো যত্ন রাখছে, আপনার সহায় সম্পদ ও দেখে রাখছে আপাতত। নিজেকে দেখে রাখলেই হয়।”
ভেবেছিলাম কিছুক্ষণ পরেই হয়তোবা মেয়েটা চলে আসবে। কিন্তু এখনো আসলো না। এতটা বিশ্বাস রাখলো আমার উপর নাকি বিশ্বাস করতে হলো। যা হোক ভালই হয়েছে। কোনো কাজ ছিলো না সারাদিন। হাসপাতাল পছন্দ করি না। কিন্তু এখন খারাপ লাগছে না।
“সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা সবসবয় চাই সব ঠিক হয়ে যাক তাই না আঙ্কেল। তাই স্বাভাবিক। যুগ যুগ ধরে তাই হয়ে আসছে। বুঝলেন কোনো না কোনো ভাবে ঠিক হয়ে যায়। গ্রিকরা বানিয়ে রেখেছে। ডিউস এক্স মাকিনা। যখনি কাহিনি জটিল হয়ে যেতো, কোন একটা ঠাকুর এসে সব ঠিক করে দিত। একজন বলতো তুমি এখানে যাও, তুমি এটা করো, তুমি ওইটাকে বিয়ে করো, এইটা খাও। ওডেসিয়াসকে বাড়ি ফেরাতে তো সবাই উঠে পরে লেগেছিলো। আর যখনি সে এমন একটা দ্বিপে আটকে গেলো যেখানে কোনো দেবতা আসবে না , সেই দ্বিপে ছিলো সারসি যে দেবতাদের বিরক্ত করার জন্যই বসেছিলো। পারসিউসের একটা মেডুসাকে মারতে যা যা লাগবে সব তো দিয়েই দেয় একজন একজন করে। অত দূরে যাওয়া লাগবে কেনো। ঘরের কাছেই দেখি। অসুরকে মারতে দুর্গা প্রথমবার না পারলে কি হয়েছে, পরের বার দশজন দেবতা মিলে দশটা হাতে দশটা অস্ত্র দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। অসুর না মেরে যাবে কই। পুরা ওভারপাওয়ারড আরকি! আর যদি সব ঠিক না হয়ে যায়, সমস্যা কি! ঠিক হয়ে যাবে! ফিনলেন্ডর এক লোককথা আছে। যেখানে মহানায়ক ফিয়ন শেষে মারা যায়, কিন্তু সে “কিং আন্ডার দা মাউন্টেন”। সে নাকি এখনো সেখানে নিদ্রিত আছে। ফিনলেন্ডের প্রয়োজনের সময় আবার উঠে আসবে। ব্রিটেনের জন্য আরথার ও একি। আর যিশু তো আসবেই আমাদের সবাইকে বাঁচাতে।”
লোকটা একদৃষ্টি তে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। কোনো কথা বলল না কিন্তু মনে হলো মনোযোগ দিয়ে শুনছে তাই আমি বলে গেলাম।
“গান শুনবেন আঙ্কেল?” পরে বললাম আমি। তিনি বুঝলেন নাকি বুঝলাম না কিন্তু আমি ফোনটা বের করলাম। গান অন করে, ভলিউম খুব আস্তে করে কানের পাশে ধরলাম। হেমন্ত মুখার্জির “আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা”, “তুমি রবে নীরবে”, শ্রীকান্ত আচার্যের “বৃষ্টি তোমাকে দিলাম”, অরুন্ধতী হোম চৌধুরীর “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন” মাঝে বিজে থমাসের “রেইন ড্রপস কিপ ফলিং অন মাই হেড” ডিন মারটিনের “এভ্রিবোডি লাভস সামবাডি” সব ছাড়লাম। লোকটার চেহারার দিকে তাকিয়ে ছিলাম কোনো অসুবিধা হচ্ছিল নাকি, কিন্তু না, চেহারায় অসুবিধা মনে হয়নি। কিন্তু খালি মনে হচ্ছিল। হঠাৎ তিনি আমাকে ইঙ্গিত করে কাছে আসতে বললেন। আমি কান এগিয়ে দিলাম। তিনি খুব আস্তে খস খস করে বললেন,
“তন্বী….”
“কি? তন্বী? হ্যাঁ কিছুক্ষণ পরেই চলে আসবে সে।” তন্বীর নাম্বারটা বোধহয় রাখা উচিত ছিলো।
“তন্বী….খে…”
“তন্বী খে?”
“তন্বী….খেয়াল…”
তন্বী খেয়াল? কি বলতে চাচ্ছেন?
“কোহিনূর…”
“কোহিনূর?”
তিনি হ্যাঁ সুচক একটা নাড়া দিলেন। এরপর আবার আগের মতো শুয়ে পড়লেন। এটুকু বলতেই যথেষ্ট কষ্ট হয়েছে। তন্বী খেয়াল কোহিনূর। মানে কি? আমাকে কাকে ভাবে কথাগুলো বললেন কে জানে। তাঁর দিকে ফিরে তাকালাম। চোখ বন্ধ করেছেন। বোধহয় ঘুম পেয়েছে। আমি বাথরুম থেকে ঘুরে আবার ফিরে আসলাম। ফিরে দেখি এখনো চোখ বন্ধ, একটু ভিন্নভাবে, গভীর ঘুমে বুঝা যাচ্ছে। একটা শান্তির পরশ আছে চেহারায়। ভালো কোনো স্বপ্ন দেখছেন? নাকি কোনো চিন্তা ছাড়া ঘুমাচ্ছেন বলে? আদও চিন্তা করার সক্ষমতা কি আছে? মৃত্যু শয্যায় হয়তোবা এতো চিন্তা থাকে না।
পাশে বসে ভাবলাম। খারাপ লাগলো না। বরং ভালই লাগলো। এই মৃত্যু মানুষের পাশে থেকে এত ভালো লাগছে? কেমন জানি মায়া হয়েছে এই লোকের উপর। এমন এক মায়া যেটা আগে খেয়াল করি নি। এজন্যই কি মানুষ ব্রহ্মাশ্রম খুলে রাখে? এই মায়ার লোভে? আমি কি তাহলে-
আমার চিন্তার মাঝে ব্যাঘাত ঘটিয়ে তন্বী মাত্র ফিরে আসলো। পাক্কা ঘনটা খানেক পরে। চিন্তায় মগ্ন ছিলাম বলে তাঁর কথা শুনে একটু হকচকিয়ে উঠি।
“কি হল?” আমার চেহারা টের পেয়ে সে জিজ্ঞেস করলো।
“একটা খারাপ সময়ে এসেছ।”
“কেনো?”
“একটা কেথারসিস চলছিলো আমার।”
“ভাই রে ভাই।”
সে বলল আজকের দিকে কাজ শেষ, বাইরে একটু বসতে সে ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসছে। আমি নিচে হলে গিয়ে বসলাম সে কিছুক্ষণ পরেই এসে পাশে বসলো।
“ভালো লাগছে এখন?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“আগের থেকে একটু ভালো। কিছুক্ষণ হেটে দেখলাম রাস্তার পাশে একটা বাগানের দোকান খুলে বসে আছে। অনেকক্ষণ সব গাছ দেখে শেষে আর কিছুই নিলাম না। অবাক হলাম লোকটা একটুও বিরক্ত হলো না। এরপর ভাবলাম ফেরত যাই কিন্তু মন চাইলো না। আসলাম এই যেহেতু, মনটা খালি করেই আসি। এক বন্ধুকে ফোন দিলাম। ফোনের টাকা শেষ না হয়া পর্যন্ত কথা বললাম। হাটতে হাটতে ততক্ষণে ঐ শপিং মলের সামনে চলে এসে পরেছিলাম। পরে ঢুকে একটু কেনাকাটা করলাম। অনেকদিন পর একটা দেখে শুনে জামা কিনলাম।”
সে জামা টা বের করে দেখালো, সুন্দর একটা বেগুনি রঙের জামা, দেখে মনে হলো তাঁর উপর বেখাপ্পা লাগবে না।
“আর তুমি?”
আমি বললাম কিভাবে আঙ্কেলকে “ডিউস এক্স মাকিনা” বুঝালাম, গান শুনালাম। পাশের আন্টির গল্প বললাম, অবশি সে তা আগেই শুনেছে। সে হাসল,
“তোমার কথার কোনো উত্তর দিয়েছে?”
“দিয়েছে বইকি। যে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ছিলো আর কি উত্তর দেয়া লাগে। হ্যাঁ হু না করে কথা বলেছে মাঝে মাঝে। অবশ্য মাঝে তোমাকে নিয়ে কি যেনো বলল, বুঝি নাই।
“কি?”
“বলল তন্বী তারপর খেয়াল তারপর কোহিনূর।”
“তন্বী, খেয়াল? তন্বীর খেয়াল রেখো?”
“এহ? হুম, হতে পারে।”
সে কেমন একটা হেঁয়ালিপূর্ণ হাসি দিলো।
“আমাকে কে না কে ভেবে বলেছে কে জানে। আর কোহিনূরের তাৎপর্য কি হতে পারে।”
“কোহিনূর..কোহিনূর” সে ভাবলো কিছুক্ষণ,
“অনেক ছোট থাকতে। 3 বা 4 এ পড়তাম হয়তোবা। তখন মা নিতে আসতো স্কুল থেকে কারন ভালই দূরে পড়তাম। তো স্কুলটা ছিলো একটু ভিতরের দিকে। তাই ছুটি হয়ার পর আমি এগিয়ে কোহিনূর নামের একটা দোকানে গিয়ে দাড়াতাম। ওখান থেকে মা আসতো নিতে। তো একদিন দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি মায়ের খবর নাই। তো আসলে ঐ দিন বাবা আমাকে নতুন স্কুলে প্রথমবার আনতে গিয়েছিলো। কিন্তু সে জানতো না আমি কোহিনূরের সামনে দাড়াই। তাই সে খুঁজতে ছিলো আমাকে স্কুলের দিকে। বিকাল থেকে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিলো সে আর খুজে পায় না। সে মাকে কল ও দেয় না। কথা শুনতে হবে বলে। একদিন গিয়েছো কিন্তু তাতেই খুজে পাও না। অর্ধেক বছর চলে গেলো তাও জানো না মেয়েটা কোথায় দাঁড়ায় থাকে। এসব আরকি।বাবা শুধু হন্যে হন্যে খুঁজতে লাগলো। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো আমি আর পারি না কান্না আটকাতে তাও ধরে রেখেছি। দোকানের আঙ্কেল বলল কল দেয়া লাগবে নাকি আমিও বলি না! না! আজকে দেরি করার এই কথা ছিলো। সন্ধ্যার শেষের দিকে এসে বাবা আমাকে খুজে পেলো। সে কি কান্না! আমি কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম। ভেবেছিলাম মা কোনো কারনে রাক করেছে বলে আমাকে আনতে আসেনি তাই বাবা এসেছে। কিন্তু পরে বাবা বলতে লাগলো। মা ভুল হয়ে গেছে। রাক করো না! এসব। কি যে কষ্ট পেয়েছিলাম! বাবা আমার রাগ কমানোর জন্য আমার যা ইচ্ছা ওইদিন তা কিনে দিয়েছে। খালি আমরা এই দোকান ঐ দোকান ঘুরেছি। যাতে আমি মাকে না বলি যে বাবা খুজে পায় না বলে এতো দেরি। আমিও পরে সায় দিলাম। বাবা বলল যে ঘুরাঘুরি করতে গিয়ে এতো দেরি। পরে অবশ্যি একদিন বাবার উপর রাক করে মাকে বলে দিয়েছিলাম! সে কি আরেক তুমুল কাণ্ড।”
কিছুক্ষণ পর আমরা বের হলাম। যে কাজ টা মাথার মধ্যে বানিয়ে নিয়েছিলাম। সেটার সময় হয়ে গিয়েছে। যাওয়ার সময় সে ধন্যবাদ জানালো। বলল পরের দিন আমাকে খিচুড়ি খাওয়াবে নে। আমি বললাম পরে যেদিন ইছহে হবে আমাকে ডাক দিতে। আবার আসব আঙ্কেলের সাথে দেখা করতে।
কিন্তু আঙ্কেলের সাথে আর দেখা হলো না। দুদিন পর তিনি মারা গেলেন। তন্বীর সাথে কথা হলো পাঁচদিন পরে। সে ফোন করলো আমাকে। কিভাবে মারা গেলেন তা নিয়ে একটু বিস্তারিত জানালো।
“একটা কথা বলি?” সে বলল। খুব আস্তে। যেনো লুকিয়ে লুকিয়ে বলছে। তাঁর হালকা শ্বাসগুলোও হালকা বেতারের মতো আসছে।
“বলো।”
“কেমন জানি হালকা লাগছে।”
“সমস্যা নাই। এর জন্য কেও তোমাকে দোষারোপ করবে না।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
“আপু আর আমি ভাবছি দোকান টা বিক্রি করে দিবো। বাসাটাও। তাদের ঘরের গিয়ে
উঠবো কয়েকদিন। এরপর কি করব ভেবে নেয়া যাবে।”
“দেখো তোমার জন্য কি ভালো হয়।”
“তোমার ও তো দায়িত্ব আছে না একটু?”
“ কি দায়িত্ব?”
“আমার খেয়াল রাখার কথা না তোমার?”
একটু ভড়কে গেলাম আমি। কি বললে ভালো হয় ভেবে নিলাম। কিন্তু ভালো কিছু আসলো না।
“যদি খেয়াল রাখতেই হয় রাখবো। যেভাবে পারবো আরকি।”
“এটা কোনো কথা বললা? সুন্দর করে বলবে তো একটু। মেয়ে মানুষ তো আমি। বলবা হ্যাঁ তন্বী অবশ্যই তোমার খেয়াল রাখবো। সারাজীবন রাখব।” তাঁর কন্ঠে কোনো বিদ্বেষ ছিলো না। শুধু ছিলো রস।
“আচ্ছা তাহলে তাই। অবশ্যই তোমার খেয়াল রাখবো তন্বী” হেসে বললাম আমি।
“তাই ভালো।”
“একদম?”
“একদম।”
Inspired by Haruki Murakamis “Norwegian Wood” (1987)